অপারেশনের ক্ষণেঃ মামার হার্নিয়া অপারেশন

যে উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম সেটা সফল হল। তারপর মামাকে নিয়ে আমরা হাসপাতালে চলে গেলাম। মাগরিবের নামাজ শুরু হয়ে গেল। শান্ত এর মধ্যে ডাক্তারের সাথে কথা বললেন। স্যার বললেন নামাজ থেকে এসে উনি দেখছেন বিষয়টা। বন্ধু তখন আমাকে অ্যাকাউন্টেন্ট ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমাকে পরিচিত করিয়ে মামার ব্যাপারে খুলে বললেন। মামা তখন বাইরেই পায়চারি করছিলেন হাসপাতাল টা ঘুরে দেখছিলেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার সাহেব চলে আসলেন চেম্বারে। এসে প্রথমে শান্ত মামার ফাইলগুলো নিয়ে ডাক্তারকে দেখালেন। ভেতরে কি চলছিল সেটা বুঝা যাচ্ছিল না। মামার আবার এর মধ্যে চাপ দিল প্রস্রাব। এমনিতেই ডায়বেটিস রোগী। স্লাইটলি ডায়াবেটিস তো আছেই। তেমন একটা মেইনটেন করেন বলেও বোঝা যায় না। এর মধ্যেই শান্ত ডাক্তার স্যারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে, “মামা কোথায়? স্যার দেখতে চান কন্ডিশনটা। ফিট হলে আজকেই অপারেশন করিয়ে ফেলবেন।” মামা আসলেই মামাকে নিয়ে স্যারের রুমে নিয়ে গেল শান্ত।
কন্ডিশন দেখে স্যার বললেন আজকেই অপারেশন করিয়ে ফেলা যাবে। মামা আসলে আগে যে হাসপাতালটাতে গিয়েছিল সেখানেই অপারেশনটা করা তো কিন্তু ওইদিন সিট খালি ছিল না। আর আমার হাতেও তেমন সময় ছিল না সাথে মামার শালা ও এসেছে। সেও বেশি দিন থাকবে না। উনি মূলত ওমান থাকেন। দেশে এসেছেন আর বাড়িতে কিছু জায়গা জমির ঝামেলা নিয়ে ছিলেন এতদিন। কিন্তু ওনার দাদা বাবুর আহবানে আর সাড়া না দিয়ে পারলেন না। উনি প্রায় বিকাল পাঁচটা নাগাদ এসে পৌছলেন। তখন আমি আর মামা আগে থেকেই হাসপাতালে ছিলাম। আর মাগরিবের পরে তো বন্ধুর হাসপাতালেই চলে আসলাম। স্যারের ভিজিট টা দিয়ে মামা বেরিয়ে আসলেন আর সুগার চেক করার জন্য মামাকে আরেকটা টেস্ট করানো লাগলো। বেশি না দেড়শ টাকার একটা টেস্ট।মামা টেস্ট করাতে যাচ্ছে তখনই আবার আমরা অ্যাকাউন্টেন্ট ভাইয়ের রুমে গেলাম। তখন মামা দেখে ওনাকে চিনে ফেললেন। “আরে ভাই আপনি রাজগঞ্জের না? রাজগঞ্জে দোকান আছে না? ” মাহবুব ভাই উনিও মামাকে দেখে চিনে ফেললেন।মামাকে অভয় দিলেন এবং বললেন যে কোন সমস্যা নেই উনি দেখবেন যতটুকু সম্ভব। মামা তখন পরীক্ষার জন্য দিয়ে আসলেন আর স্যার বললেন যে রাত আটটার মধ্যেই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতে। তখন বাজে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা দশ মামা ব্লাড দিয়ে আসলেন এবং বন্ধু রিকোয়েস্ট করলো যেন তাড়াতাড়ি রিপোর্ট প্রদান করে। বন্ধু আমাদের জন্য একটি কেবিন ঠিক করল এবং চতুর্থ তলায় অপারেশন থিয়েটার যেখানে ওই তলাতেই আমরা রুমে উঠলাম।
ওই জায়গায় কর্তব্যরত নার্সদের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়া হলো। আয়া খালারা আসলেন আমাকে বললেন লুঙ্গি লাগবে। আর গায়ে যত অলংকার আছে সেগুলো খুলে যেতে হবে। অলংকার বলতে মামার কেবল কলা একটা তাবিজ আর তেমন কিছু নেই। তো মামাতো একেবারেই অপারেশনের জন্য অপ্রস্তুত ছিল সে সময়। কিন্তু আমরা মামাকে অভয় দিলাম কি আজকেই করতে হবে। মামাকে বললাম সবকিছু ধীরে ধীরে রেডি করতে এবং আমি নিচে চলে গেলাম মামার জন্য লুঙ্গি আর গামছা আনতে। মামা বাসায় ফোন দিয়ে উনার শালাকে আসতে বললেন। আমি নিচে গিয়ে মামার জন্য একটি ভালো মানের লুঙ্গি ও একটি গামছা নিয়ে আসলাম। এর মধ্যে আসতে আসতে মামা সালেও চলে এসেছেন। এ কিছুক্ষণ পর আবার খালারেও চলে এসেছেন এবং উনারা আসতে আসতে মামাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানো হয়ে গিয়েছিল। মামা একটু নার্ভাস ছিলেন আমার বন্ধু থেকে জানলাম বিষয়টা। খালাদের কি রুমে বসতে বললাম আর আমি অপারেশন থিয়েটারের কাছে গিয়ে বসলাম। প্রায় আটটা দশ মিনিট নাগাদ মামার অপারেশন শুরু হয়েছিল। তো কিছু ওষুধ আনার ছিল অপারেশনের জন্য আমাকে লিস্ট দিল এবং আমি নিচে ফার্মেসিতে গিয়ে বন্ধুর রেফারেন্সে ওষুধ গুলো নিয়ে আসলাম। প্রায় এক মিনিট হবে অপারেশন প্রায় শেষের দিকে আর মামার দেওয়া হয়েছিল এনেস্থিসিয়া ওনার উপরে কাজ করেনি।যার দরুন ওনার হুশ চলে আসে হুশ চলে আয়। উনি নাকি অপারেশনের সময় উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখছিলেন কি হচ্ছিল ওনার সাথে। তখন ডাক্তার আবার উনাকে বুপি যেটা নাকি এনেস্থেশিয়া দিতে বলেন। দুইবার এনেস্থেশিয়া দেওয়ার পরও মামাকে আর ঘুম পাড়ানো যায়নি। প্রায় ৯:০০ টা নাগাদ মামা কে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করা হয়। তোমার সাথে আমার খালারা ছিলেন মামার শালা ছিলেন উনি পূর্ণ জ্ঞানে ছিলেন এবং ওনাকে এই অবস্থাতেই বেডে শিফট করা হয়। তখন ওনাকে ঘুমানোর জন্য পরামর্শ দিয়ে যান। সেখানে ফিলিস্তিনের একজন ডাক্তার উনি ছিলেন স্যারের ছাত্র। উনি ঐ রাতের জন্য ডিউটি ডাক্তার হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন। এসে উনি মামাকে দেখে গেলেন কথা বলে গেলেন কি রোগীর অবস্থা। মামাকে উনি কোন চিন্তাভাবনা না করে সুন্দর করে ঘুমোতে বললেন। নার্স এসে অনেকগুলো ইনজেকশন দিয়ে গেল এবং স্যালাইন চড়িয়ে দিয়ে গেল। ঐদিন রাতের জন্য আর কিছু খাওয়া যাবেনা বলা হলো তো রাত বারোটার পরে সামান্য জল এবং পরদিন সকালে হালকা খাবার গ্রহন করতে পারবেন। আর এর আগে কোন ব্যাথা বা ঘুমের ওষুধ দেওয়া হলো না। তখন রাত প্রায় দশটার কাছাকাছি খালাদের বললাম চলে যেতে এখনই আর রাত না করতে। আর মামার শালাকে পাঠালাম আমার জন্য বাসায় গিয়ে ভাত নিয়ে আসতে আর নিজেও খাওয়া দাওয়া করে আসতে। বন্ধু তখন অনেক রাত পর্যন্ত আমাকে সময় দিয়েছে ওকেও আমি পাঠিয়ে দিলাম ওর বাসায়। সবাইকে বিদায় দেওয়ার পর ডাক্তারের কথামতো তখন আমি ঘরের লাইটটি নিভিয়ে নিচে গেলাম একটু সিগারেট সাটাতে। তখন বন্ধু শান্তকে বিদায় দেওয়ার পালা। তখন ফার্মেসিতে রাতের ডিউটি করার বড় ভাই আসলেন যার সাথে শান্ত আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। বন্ধু শান্তর আবার কোন সিগারেট বা পান খাওয়ার মতো বদ অভ্যাস নেই। কিন্তু সে সকলকে খাওয়াতে খুব ভালোবাসে। যেই আসছে তার পরিচিত সে আপ্যায়ন করছে কিছু না কিছু খাওয়ার জন্য। ওর আতিথেয়তা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বড় ভাইয়ের সাথেও কথা বলতে বলতে আরেকটা সিগারেট ফাটিয়ে দিলাম। বন্ধুকে বিদায় দিয়ে এবার উপরে চলে গেলাম। উপরে গিয়ে উঁকি দিতেই দেখি মামা তখনও ঘুমায়নি। আরে একি আজব। দুটো বুপি দিয়েও কোনো কাজ হলো না। এ খুব অদ্ভুত ব্যাপার তো।
বিছানার এপাশ থেকে ওপাশ শুধু ছটফট করছেন। লাইট টা একটু জ্বালালাম। দেখি মামা পুরোই অস্থির। বললাম ঘুমান ত একটু কষ্ট করে। প্রথম রাতে ত একটু ব্যাথা করবেই। আমি বসে মোবাইলে স্ক্রল করতে লাগলাম। তখন প্রায় ১১ টার কাছাকাছি। মামার শালা বাসা থেকে খাবার নিয়ে চলে আসলো। একটি তিন থাকের টিফিন ক্যারিয়ার যেখানে ভাত, কিছু ভাজি, একটা মাছের তরকারি আর ডাল। রুমের এটাচ বাথরুম থেকে হাত টা ধুয়ে এসে মোবাইলের ফ্ল্যাশ টা জ্বালিয়ে খেতে বসলাম। অনেক মশা জ্বালাতন করছিল। ১৫ মিনিটের মধ্যে খেয়ে থালা বাসন গুলো ধুয়ে ছোট সিঙ্গেল খাট টায় একটু বসলাম। এর কিছুক্ষণ বাদেই মামা আরো বেশি ছটফট করতে লাগল। ওনার ব্যাথা নাকি আরো তীব্র গতিতে বাড়তে শুরু করল। কিন্তু তখন তো রাত বারোটা বাজেনি। ওনাকে রাত বারোটার আগে ওষুধ দেওয়া যাচ্ছিল না। আরো ধৈর্য ধরতে বললাম মামাকে। কিন্তু উনি তো ধৈর্য ধরতেই পারছিলেন না। উনার শালাকে গিয়ে বললাম একটু মাথাটা টিপে দিতে। যদি উনি একটু ঘুমাতে পারেন। তখনো প্রায় ১১:৪৫ বাজে। ডাক্তার স্যার বলেছিলেন বারোটার দিকে পানি খেতে। কিন্তু মামার ছটফট এর জন্য আমি গিয়ে নার্সকে ডেকে আনলাম। মেইল নার্স ছিলেন উনি। মামাকে বললেন যে বারোটা বাজলেই উনি ইনজেকশন দিয়ে দিবেন। মামা একটু আশ্বস্ত হলেও ওনার ছটফটানি কমেনি। আমি বুঝতে পারলাম না ওনার কেন ঘুম আসছিল না। ডাক্তার অবশ্য ঘুমের ওষুধ দিতে বারণ করেছিলেন। মামা শালা আস্তে আস্তে উনাকে মাথা টিপে দিতে লাগলো। কিন্তু মামার কোনোভাবেই ঘুম আসছিল না। এরমধ্যেই বারোটা বেজে গেল। নার্স এসে মামাকে ইনজেকশন দিয়ে গেল। মামা ঘুমের ওষুধ চাচ্ছিলেন। কিন্তু ডাক্তারের বারণ ছিল ওষুধ দেওয়া যাবে না। এভাবে করতে করতেই রাত একটা বেজে গেল। ইনজেকশন দেওয়ার পরে ভেবেছিলাম মামার ব্যথা একটু কমে যাবে। কিন্তু তখনো ভল্টারিং দেওয়া হয়নি। রাত দুইটা বাজে তখন। মামার পায়চারি দেখে আবার নার্সকে ডেকে আনলাম। উনার ব্যথা কোনভাবেই কমানো যাচ্ছিল না। এবার আমাকে গিয়ে ডিউটি ডাক্তারকে ডাকতেই হল। ডিউটি ডাক্তার এসে মামাকে সান্ত্বনা দিলেন। অপারেশনের প্রথম রাতে একটু ব্যাথা থাকবেই। আমিও একই কথা বুঝাচ্ছিলাম। মূলত মামার প্রস্রাব ক্লিয়ার না হওয়ায় উনি খুব অস্বস্তি বোধ করছিলেন।এভাবেই ঘুম বিহীন আমাদের সবার রাত কেটে গেল। মামাকে কোনভাবেই শান্ত করা যাচ্ছিল না। এ যেন এক বিভীষিকা। আমরা কেউই আর ঘুমাতে পারলাম না। ভোর হলো আমি বেরিয়ে গেলাম সিগারেট আনতে। আর সিগারেট খেতে খেতে আমার ভোর কেটে গেল।

1 thought on “অপারেশনের ক্ষণেঃ মামার হার্নিয়া অপারেশন”

Leave a Comment