
অনয় খুবই পরিশ্রমী একজন ছেলে। গ্রামের মেধাবীদের মধ্যেই একজন ছিল। তার বাবার পাইকারি দোকানের ব্যবসা। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সেই সবার বড়। মূলত ৪ জন ভাই বোন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাবার ব্যবসাতেই সময় দেওয়া হয়। সেখানে সময় দিতে দিতে তার জীবনের যৌবনের একটা বড় অংশই শেষ হয়ে যাচ্ছে। সেও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকে আবার ব্যবসায় ফিরে যেতে হলো। বাবার পক্ষে একা এই ব্যবসা চালানো সম্ভব ছিল না৷ পাইকারি ব্যবসা হলেও ব্যবসা টা বড় কোন ডিস্ট্রিবিউশন এর নয়। লোকাল ভাষায় ‘বাজে মালের’ দোকান বলা হয়। মানে ছোট ছোট জিনিসের সমাহার। গ্রামে ১ টাকা, ২ টাকা, ৫ টাকার জিনিসের চাহিদা অনেক। বিস্কুট,চানাচুর, চকলেট আরো হাবিজাবি। লোকাল প্রোডাক্ট ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান এর জিনিসপত্র যেগুলো বাচ্চাদের জন্য সুলভ মূল্য এ সকল দোকানে পাওয়া যায়। বিভিন্ন গ্রামের খুচরা দোকানিরা তাদের দোকান থেকে এ মাল গুলো নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে। বেশ ভালো ডিমান্ড আছে এ সকল প্রোডাক্টের। দেশীয় কোম্পানিগুলো মানসম্মত না হলেও অনেক আকর্ষণীয় লটারি,গিফট, খেলনা এ সকল কিছু দিয়ে জিনিসপত্রগুলো বাজারে ছেড়ে থাকে। যার কারণে গ্রামের বাচ্চারা কম দামে এ সকল প্রোডাক্ট গুলো কিনতে আগ্রহী থাকে। তার পাশাপাশি চানাচুর, বিস্কুট, চকলেট, শ্যাম্পু, সাবান সহ অনেক মাল থাকে। নতুন কোম্পানির জন্য প্রচারের প্রয়োজন সে মালগুলো এসকল পাইকারি দোকানে দেওয়া হয়ে থাকে। তাই দোকানে মালের পরিমাণ অনেক বেশি আইটেমের মাল থাকে। সবকিছু মনে রাখতে হয় সে অনুসারে থেকে প্রদানও করতে হয়। এই কাজের জন্য কর্মচারী থাকা অত্যাবশ্যক কিন্তু অনয়ের বাবার তেমন অর্থ সঞ্চয় নেই। সে বিষয়ে পরে আসছি। কেন কি হয়েছে? কারণ ওনাদেরও আর্থিক অসচ্ছলতা ছিল। তিন বোনের বিয়ের দায়িত্ব হলো বাবা সে ব্যাপারে সম্পূর্ণটাই মিটিয়ে ফেলেছেন। এবার অনয়েরও বিয়ে হলে পরিবারে অনয়ের বাবার শেষ বড় দায়িত্বটাও সম্পন্ন হয়ে যায়। আর অনয়ের মা ও চাচ্ছেন ওনার সহায়তাকারী একজন দরকার। বয়স ও বাড়ছে। ঘরের এত কাজ একা হাতে সামলানোটা এখন ভারী কঠিন ই হয়ে যাচ্ছে। আর কোমরের ব্যাথা টাও বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন। আর অনয়ের ও তো কম বয়স হলো না৷ এখন বিয়ে করাটাও ওর জন্য জরুরি। তাই তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য ঘরের সবাই মোটামুটি উঠে পড়ে লেগেছে। তো ওনার বোন জামাইরা বিয়ের ভার টা দেখছেন। মেয়ে দেখার দায়িত্ব দেওয়া হল বড় বোনের জামাইকে। উনি একটা সম্বন্ধ পেলেন যেটা আসলো মাধবপুর থেকে। মাধবপুর হচ্ছে হবিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি গ্রাম। সেখানে মেয়ের ছবি পাঠানো হলো। আগে পরিবার থেকে সকলেই মেয়ের ছবি দেখে পছন্দ করলো। এখন মেয়ে দেখবে বলে সকলে মনস্থির করল। তো সপ্তাহের একদিন সকলে ঠিক করে বোনেরা আসলো ওনার জন্য মেয়ে দেখতে। সকলে রওনা হলেন। সেদিন ছিল বুধবার বেশ ভালো ঝলমলে একটি দিন। সেদিন বলে একটি গাড়ি নিয়ে মেয়ে দেখার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন সকলে। অনয়ের দুই বোন ও বোন জামাইকে নিয়ে। অনয় ও সাথে ছিল ওনাদের। মেয়ের বাড়ি প্রথমে ভেবেছিলেন ওনারা শ্রীমঙ্গলে। কিন্তু বুঝতে ভুল হয়েছিল মেয়ের বাড়ি আসলে মাধবপুর শ্রীমঙ্গলেরও পূর্বে হবিগঞ্জ জেলায়। ওনারা সকাল সকাল পৌঁছে গেলেন। প্ল্যান ছিল আগে শ্রীমঙ্গল গিয়ে তারপর বিকালবেলা মেয়ে দেখে ফিরে আসবেন। কিন্তু স্থান পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। যাই হোক সকালে গিয়ে, সকাল বললে ভুল হবে প্রায় দুপুর নাগাদ গিয়ে পৌঁছালাম সবাই।
মেয়েকে দেখে সকলের পছন্দ হলো। অনয় যদিও দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছিল। মেয়ের সাথে কথা বলতে পারেনি। তো মেয়ে এর ব্যাপারে ওর বোনেরা পজিটিভ রিভিউ দিল। যার কারণে সেই কথা আগানোর জন্য এসে সকলে পৌঁছালেন। বোঝানোর পর মেয়ের ব্যাপারে আঙ্কেলের একটু মত ছিল যে মেয়ে হয়তো বা একটু কালো হতে পারে চোখেও সমস্যা হতে পারে। ছবি দেখে বোঝা যায় না। তারা চিন্তা করেছিল পরবর্তীতে মেয়ে দেখার পরে সেই ভুলটা ভেঙে যায়। মেয়ের সম্পর্কে তাদের মধ্যে একটা পজিটিভ ধারণা সৃষ্টি হয়। মেয়ের মা বেঁচে নেই। বাবা চাচ্ছেন মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করাতে। এ বিষয়ে অনয় ভাবছে হয়তোবা মেয়ের বাবা আরেকটা বিয়ে করতে পারেন। তিনি তাড়াহুড়ো করছেন মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তারপর নিজের বিয়েটা সেরে নিতে। এর সত্যতা কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা মেপে বলা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তারপরেও তাদের মেয়ের বাড়ির দেখে ভালই লাগলো। তেমন কোন মেয়ে মানুষ তাদের আপ্যায়ন করতে পারল না। কেননা মা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য থাকেন একটা পরিবারের। যখন মা-ই থাকবে না তখন আসলে এই আপ্যায়নের বিষয়টি অনেকটাই ভুলে যেতে হতে পারে। তারপরও মেয়ের বাড়িতে যারা ছিলেন তারা মোটামুটি ভালই আপ্যায়ন করেছিলেন। তো সন্ধ্যা নাগাদ সকলেই রওনা দিয়ে ফেললেন। থেকে মা-বাবাকে সবকিছু খুলে বলল বোনেরা। অনয় আসলে তেমন কিছু বলল না কথা হচ্ছে মেয়ে যদি পছন্দ হয়ে থাকে তোমরা ভালো যা বুঝ তাই কর। অনয় সে বিষয়ে নিজের উপর দায় এটা নিতে চায় না। পরিবারের অমতে বা অপছন্দের কাউকে এনে তার পরে যেন ওকে আর কোন কথা শুনতে না হয়। অনয় বেশ ভেবেচিন্তে এ বিষয়গুলোর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। ইতোপূর্বে ও তার এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাকে কথা শুনতে হয়েছে পরিবারের পক্ষ থেকে যেকোন ছোটখাটো বিষয়গুলোতে। আর এতো বিয়ে। ব্যাপারটা আরো বেশি সেনসিটিভ। এ ব্যাপারে নিজের উপর কোন দায় ই বহন করতে চাচ্ছে না। পরিবারের পছন্দ হলেই অনয়ের পছন্দ। আচ্ছা এবার মেয়ের বাড়ির কথায় ও তো আসতে হবে। ওনারা কেমন ছেলে দেখলেন। ওনাদের ছেলে পছন্দ হয়েছে কিনা সে বিষয়ে শোনার পালা। শুনতে আর বেশি দেরি হলো না। পরের দিনই ফোন দিয়ে মেয়ের পক্ষ জানালেন ওনারা ছেলেকে দেখতে আসতে চান৷ বেশ ভালো একটি সংবাদ। তার মানে বোঝা যাচ্ছে ছেলেকে ওনাদের পছন্দ হয়েছে বৈকি। এখন তারিখ ঠিক করে বলবেন ওনারা কবে কতজন আসবেন। শিমুল এই সকল সূচিকা গুলো ঠিক করছিলেন। পরের সপ্তাহে বুধবারে ওনারা আসবেন বলে ঠিক করলেন। বেশি কেউ নন। কেবল মেয়ের বাবা ও মেয়ের পিসেমশায়।
তো অনয় ব্যাপারটা শুনে বেশ ভালো বোধ করল। উনার ফ্যামিলি মেম্বাররাও বেশ ভালোই উত্তর পেলেন। এখন মেয়েকে ওনাদের পছন্দ হয়েছে। দুই একজন আরো কিছু মেয়ের সমন্ধ আসলেও সেগুলোতে আর কথা বাড়ালেন না। মেয়ের বয়স তেমন বেশি হবে না। এইবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। তবে ১৮ প্লাস। বিয়ে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত। তো বুধবারকে লক্ষ্য করে সকলে আবার বাড়িতে আসবে বলে পরিকল্পনা করলো। কিন্তু এর মধ্যেই সোমবারে আরেকটি দুঃসংবাদ চলে আসলো অনয়ের। কাকা তো জ্যাঠা পরলোকগত হয়েছেন। অর্থাৎ বাবার কাকাতো ভাই। সেক্ষেত্রে সনাতন ধর্মের নিয়ম অনুসারে ব্রাহ্মণ হওয়ায় অনয়দের সাত্ত্বিক আহার ভোজন করতে হবে ১১ দিন। এর মধ্যে আবার মেয়ে বাড়ির লোকজন আসছেন। ওনাদেত আপ্যায়ন করার বিষয়টা তখন অনেকটাই সাত্ত্বিক আহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। যাই হোক সে ব্যাপারে মেয়ে বাড়ির লোকজনদেরও জানিয়ে দেওয়া হলো। উনারা আসবেন বলে নিশ্চিত করলেন। বুধবার সকাল বেলা এসে পৌঁছবেন বলে মনস্থির করলেন। সেই হিসেবে অনয় যে তাকে দেখতে আসবে। অনয় ভেবে রেখেছিল অবশ্যই উনারা প্রথমে তার দোকানের দিকে আসবেন। দোকান থেকে তারপর বাসার দিকে আসবেন। ঠিক তার চিন্তাই ফলপ্রসূ হল। প্রথমেই ওনারা দোকানে গেলেন। তখন অনয় দোকানে উপস্থিত ছিল। উনার বাবা ছিলেন বাসায়। অতিথিদের আপ্যায়ন করার জন্য উনার বাড়িতে অবস্থান করতে হতো। অনয় এবং অনয়ের দোকান দেখে ওনারা বেশিক্ষণ দেরি করলেন না। শুধু ফরমালিটির জন্য টুকটাক প্রশ্ন করলেন যে, অনয়ের বাবা কোথায় আছেন? আর অনয় কখন বাসায় যাবেন? অনয় বললেন আপনারা আগে যান আমি তো অবশ্যই আসছি। একটু পরেই আসবো। এই টুকটাক কথা বলেই অনয়ের বাসার উদ্দেশ্যে ওনারা প্রস্থান করলেন।
দুপুর নাগাদ অনয় বাসায় ফিরে আসলো। এসে দেখলেন যে অতিথি সকলে ওর জন্য অপেক্ষা করছেন। অনয় আসার পর টুকটাক আলাপ আলোচনা করে সকলে দুপুরের খাবার খেতে বসলেন। দুপুরের খাবার খেয়ে মেয়ের বাড়ির লোকজন আর দেরি করলেন না। চলে গেলেন ওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তখন শুধু অপেক্ষায় ছিল যে এখন কতটুকু পাকাপোক্ত হলো। সে অপেক্ষার অবসান ঘটবে ওনারা যখন জানাবেন যে উনারা এগুচ্ছেন কিনা এই সম্বন্ধে। বেশি দিন আর অপেক্ষা করতে হলো না। শিমুল ভাইয়ের কাছেই তো ছিল আসল চাবিকাঠি। শিমুল ভাই পরের দিনে খোঁজ নিয়ে নিলেন ছেলের সম্বন্ধে। ওনারা কি চিন্তা করছেন। উনারা সিদ্ধান্ত দিলেন যে ছেলে ওনাদের পছন্দ হয়েছে। এখন পরবর্তী কার্যক্রমে সম্মতি হলে এগিয়ে যাওয়া যায়। অনয়ের পরিবার তো খুব খুশি হলো। ছেলের বিয়ে এখন কনফার্ম। এতদিনের ক্যাচাল ওনারা মিটাতে পারছেন। অনয়কে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করা হয়েছে। এখন বিয়ের আগে আরেকটি প্রোগ্রাম করতে হবে যেটা হচ্ছে আশীর্বাদ। অনয় এত এতগুলো ঘটনার মধ্যে একটিবারও কোন কথাই বলেনি। সবকিছু শুধু পর্যবেক্ষণ করেছে। মেয়ের সাথে যদি ওর কথা হয়নি। কিন্তু মেয়ে কেও ওর বেশ ভালই লেগেছিল।