প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও আমাদের জীবনধারা

এক নতুন দিনের সূচনা

স্কুলে পড়াকালীন সময়ের কথা। একদিন বাংলা ক্লাসে স্যার হঠাৎ বললেন, “আগে পত্রিকায় খবর পড়তে সময় লাগত, এখন মোবাইল খুললেই সব হাতে চলে আসে—এটাই ডিজিটাল যুগ।” সবাই হেসে ফেলেছিল। অথচ আমরা বুঝিনি, এই ‘ডিজিটাল যুগ’ আমাদের জীবনে কত বড় পরিবর্তন নিয়ে আসছে।

প্রযুক্তি এখন আর বিলাসিতা নয়, জীবনযাপনের অংশ। ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল হাতে নিই, রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত স্ক্রিনে চোখ—এই অভ্যাস আমাদের সবাইকেই ঘিরে ফেলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি শুধুই আশীর্বাদ, নাকি কোনো বিপদের ঘণ্টাও বেজে উঠছে?

প্রযুক্তির আশীর্বাদ যেভাবে বদলে দিল আমাদের জীবন

১. শিক্ষা ও জ্ঞানের বিশ্ব দরজা

ডিজিটাল প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় উপকারের দিক—জ্ঞান অর্জনের অবারিত সুযোগ। আগে যে বিষয়গুলো জানার জন্য লাইব্রেরিতে গিয়ে বই খুঁজে বের করতে হতো, এখন গুগলেই সব পাওয়া যায়। ইউটিউব, কুরসেরা, খান একাডেমি কিংবা Sailor Academy’র মতো প্ল্যাটফর্মে ঘরে বসে বিশ্বমানের শিক্ষা নেয়া যায়।

২. যোগাযোগের বিপ্লব

চিঠি লিখে দিন গুনতে হতো—এখন হোয়াটসঅ্যাপ, ইমেইল বা ভিডিও কলেই মুহূর্তে দূরের মানুষকে কাছে আনা যায়। করোনা মহামারিতে অনলাইন ক্লাস, ভার্চুয়াল অফিস—সবই সম্ভব হয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তির জন্য।

৩. অর্থনৈতিক সুযোগ ও কর্মসংস্থান

ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স, ডিজিটাল মার্কেটিং—এইসব খাত বাংলাদেশে হাজারো তরুণকে আয় ও স্বাধীনতার নতুন পথ দেখিয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণেই অনেকে গ্রামে বসেও আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টের জন্য কাজ করছেন।

৪. স্বাস্থ্যসেবায় উন্নতি

অনলাইন ডাক্তারের পরামর্শ, ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক, মেডিকেল অ্যাপ—সব কিছুই মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতাকে বাড়িয়েছে। এমনকি উন্নতমানের গবেষণাও এখন অনেক সহজ হয়েছে প্রযুক্তির বদৌলতে।

কিন্তু… প্রযুক্তির এই আশীর্বাদ কি সবসময় মঙ্গল বয়ে আনে?

১. মানসিক স্বাস্থ্য ও একাকীত্ব

একদিন একটি কলেজছাত্রীর কথা শুনেছিলাম—“আমি দিনে ৬-৭ ঘণ্টা ফোন স্ক্রল করি, কিন্তু আমার মনে হয় আমি খুব একা।” এটা কেবল তার একার কথা নয়, ডিজিটাল আসক্তি এখন বৈশ্বিক সমস্যা।

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক—এই সব অ্যাপে মানুষ “ভালো থাকার ছবি” দেখিয়ে যায়, কিন্তু নিজের ভিতরের চাপ বা দুঃখ নিয়ে কেবল একাই থাকে।

২. গোপনীয়তা হুমকির মুখে

আমরা জানিও না—আমাদের লোকেশন, সার্চ হিস্টোরি, এমনকি কথাবার্তাও অনেক সময় কোনো না কোনো প্ল্যাটফর্মে রেকর্ড হচ্ছে। ডেটা চুরি, সাইবার বুলিং, ফিশিং অ্যাটাক এখনকার প্রযুক্তি দুনিয়ার বড় শঙ্কা।

৩. প্রযুক্তি নির্ভরতা ও কর্মহীনতা

যন্ত্র যখন মানুষের কাজ করে, তখন মানুষের প্রয়োজন কমে যায়। Automation বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির কারণে অনেক চাকরি হুমকির মুখে। আবার প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেলে সামান্য ইন্টারনেট সমস্যা পুরো কাজ থামিয়ে দিতে পারে।

৪. শিশুদের বিকাশে প্রভাব

বাচ্চারা এখন খেলাধুলার বদলে মোবাইলেই ব্যস্ত থাকে। মানবিক গুণাবলি, সহানুভূতি, দলগত কাজ শেখা—সবই কমে যাচ্ছে। এটা দীর্ঘমেয়াদে সমাজে এক ধরনের যান্ত্রিকতা তৈরি করতে পারে।

গল্প: এক ‘অতি-সংযুক্ত’ ছেলের কথা

রাজীব নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী—তার সবকিছুই প্রযুক্তি নির্ভর। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ইনস্টাগ্রাম, ক্লাস অনলাইনে, বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও গেম, রাতে ইউটিউব।

ধীরে ধীরে রাজীবের চোখে সমস্যা হতে থাকে, মনোযোগ কমে যায়, ক্লাসে আগ্রহ হারায়। ডাক্তার বলেন—“স্ক্রিন টাইম কমাও, বাস্তব জীবনে ফিরে এসো।” রাজীব বুঝে যায়—প্রযুক্তি ব্যবহার করতেই হবে, তবে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ না করলে প্রযুক্তিই তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

আসলেই তো আমরা প্রযুক্তির হাতের পুতুল। প্রযুক্তি যেভাবে চালাচ্ছি আমরা সেভাবেই চলার চেষ্টা করছি। সবার মাইন্ড ও হ্যাক হয়ে গেছে এ প্রযুক্তির কাছে। আমরা এখন তো প্রযুক্তিকে ছাড়া দৈনন্দিন কাজ কিভাবে করব সেটা কল্পনাই করতে পারি। সেটাই আমাদের কল্পনা অতীত। আমরা এখন প্রযুক্তিকে কিভাবে নিজের কন্ট্রোল থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারবো সেটাই আমরা এখন খুঁজে পেতে চেষ্টা করছি। উন্নত দেশগুলো অনেকটা সফল হলেও আমাদের মত যারা তারা এখনো অনেক কষ্ট করছে। মূলত শিক্ষা ব্যবস্থার আপগ্রেডেশন যতদিন না পর্যন্ত আমরা করতে পারব। ততদিন পর্যন্ত মনে হচ্ছে না এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। যারা আসলে মূলত শিক্ষিত সমাজের অন্তর্ভুক্ত উনারা সকলেই এই সমস্যার সমাধান করছেন। মূলত আসলে কিভাবে গড়ে উঠছে সেটা দেখে সকলেই খুবই ভয় ভীত। সকলের সমাধান চান। পরিবেশের উপর যে বিরূপ প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি তারও সমাধান কিন্তু হচ্ছে সঠিক প্রয়োগ। সেটা আসলে কতদিন নাগাদ আমরা সকলে মিলে বাস্তবায়ন করতে পারব সেটা এখন সময়ের বিষয়। এর জন্য সকল বিষয়ের সম্মুখ জ্ঞান থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা কীভাবে প্রযুক্তির ভালো দিকটা কাজে লাগাব?

১. ডিজিটাল শিক্ষার সঠিক ব্যবহার

শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার হোক মূল উদ্দেশ্য। শুধু বিনোদন নয়, বরং গঠনমূলক প্ল্যাটফর্ম বেছে নিতে হবে।

২. সময় নিয়ন্ত্রণ ও স্ক্রিন টাইম কমানো

দিনে নির্দিষ্ট সময় প্রযুক্তির জন্য বরাদ্দ করা উচিত। যেমন: ১ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ২ ঘণ্টা পড়াশোনা/স্কিল ডেভেলপমেন্ট।

৩. গোপনীয়তা ও সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা

পাসওয়ার্ড ব্যবস্থাপনা, ফিশিং থেকে সাবধান থাকা, থার্ড-পার্টি অ্যাপ থেকে সাবধান—এই সব শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।

৪. ভারসাম্যপূর্ণ জীবন

বাস্তব জীবনের সম্পর্ক, খেলাধুলা, বই পড়া—এসব বাদ দেওয়া চলবে না। ডিজিটাল দুনিয়ার বাইরে ‘আনপ্লাগড’ সময়ও দরকার।

প্রযুক্তি আমাদেরই তৈরি, কিন্তু…

ডিজিটাল প্রযুক্তি এক বিশাল আশীর্বাদ—জীবনকে সহজ, দ্রুত ও কার্যকর করেছে। কিন্তু এর ব্যবহার যদি লাগামছাড়া হয়, তাহলে সেটাই হয়ে উঠতে পারে অভিশাপ।

আমরা যেন প্রযুক্তির দাস না হই—বরং জ্ঞান, মানবিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, সচেতন সমাজ গড়তে পারি—এই হোক আজকের অঙ্গীকার।

সকল আলোচনাই কিন্তু আমাদের জানা আছে।আমরা কেবল এগুলো জানতেই শিখেছি। আমরা প্রত্যহ সকল সমস্যা দেখি। সমস্যাগুলো নিয়ে সকলের সাথে আলোচনাও করি। কিন্তু বাস্তবায়নের যখন সময় আসে তখন আমরা সকলে উদাসীন হয়ে পড়ি। এই উদাসীনতার থেকে রেহাই আমরা কখন পাবো কবে পাবো তার কোন ইয়ত্তা নেই। আমাদের এখনই সকলকে জেগে উঠতে হবে অন্যথায় কাকুরা আমাদের জন্য দুরুহ ব্যাপার হয়ে পড়বে। গেম খেলে আজকালকার শিশুরা যেভাবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে তার পরিত্রাণ কিন্তু পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ছে। আমরা বড়রাও আসলে কতটুকুই বা নিজেদেরকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে পেরেছি। গেম খেলা নিয়ে একটা মুভি দেখলাম সেখানে ডকুমেন্টের ছিল কিভাবে ১৭ বছর, ১৬ বছর, ১৮ বছর, ৮ বছর এর শিশুরা ভায়োলেন্ট হয়ে তাদের ফ্যামিলি মেম্বারকে হত্যা করেছে। জুয়ার আসক্তিতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে পরিবার। এর সকল কিছু কিন্তু পূর্বেও ছিল কিন্তু এতটা মহামারি আকারে ছিল না। পরিবারের মধ্যে এখন আগের মত সেই বন্ডিংটা দেখতে পাওয়া যায় না। সকলের সকলে জগতে ব্যস্ত। কেউ ফোন টিপছে, কেউ মুভি দেখছে, কেউ ফোনে আলাপ করছে কিন্তু কেউ কারো সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে সেটা খুব কমই চোখে পড়ে। সকলের সকলের ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত। যখন আমি লিখছি তখন ও ডিভাইসের মাধ্যমেই লিখছি। এটা একটা সৎ ব্যবহার। আবার ডিভাইসের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় ধুয়া মারছি। যাইহোক প্রযুক্তি তো আমাদের অনেক কাজকে সহজ করে দিয়েছে। হাতে না দেখেও মুখ দিয়ে বলে আমরা এখন যোগাযোগ করতে পারি। একটা সময় অপেক্ষা করতে হতো ডাকের লোক কখন আসবে। আর এখন টাকের লোককে আমরা পাঠিয়ে দেই প্রযুক্তি দিয়ে। ইচ্ছামত যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারি। কম সময়ের মধ্যে আমরা সকল কাজকে সমাধান করতে পারি। এ সকল কিছুই প্রযুক্তির আশীর্বাদের কারণে আমরা লাভ করতে পেরেছি। কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতা অনেকটাই কমে যাচ্ছে প্রযুক্তির উপর নির্ভরতার কারণে। নিজেদের মধ্যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নিজেদের উপর বিশ্বাস হারাতে চলেছি। প্রযুক্তি আমাদেরকে অনেকটাই অলস বানিয়ে তুলেছে। আমরা এখন গ্রুপের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে উঠে পড়ে লেগেছে স্ক্যামে সয়লাব পুরো ডিজিটাল জগত। কাউকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না এখন। সবাই এখন কেমন যে স্বার্থপর আর পাষণ্ড হয়ে উঠছে। ভরসা করার মত কোন স্থান নেই। সবাই যেন ঠকানো তে ওস্তাদ। এ এক আলাদা উৎকর্ষ। নতুন ধারা চলছে চারপাশে স্ক্যামের। তাই প্রযুক্তি ব্যবহার করায় আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে।

আমাদেরকে আবেগী হওয়া চলবে না। আমাদের আবেগকে পুঁজি করে অনেক প্রতারক ই প্রতারণা করে যাচ্ছে দিন দিন। বিভিন্ন ব্যাংকিং খাতে প্রতারণার শিকার হচ্ছে ব্যবহারকারীরা। আর এই সকল ঘটনাই করছে আমাদের প্রবীণ জেনারেশনের সাথে। যারা সঠিকভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার জানেন না কিন্তু বিশ্বাস রাখেন। উনাদেরই ঠকানো হচ্ছে। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে মিথ্যা বুঝলো কি দেখিয়ে মানুষকে ঠকানো হচ্ছে প্রযুক্তির মাধ্যমে। তাই আমাদের সকলকেই আবেগকে দমন করা শেখাতে হবে। টাকা পয়সা আজ আছে ত কাল নেই। কিন্তু সময়ে সচেতন হওয়াটা আমাদের সকলেরই গুরুদায়িত্ব। আমাদের সচেতনতাই আমাদেরকে প্রযুক্তির সুফল গ্রহণ করতে সর্বাত্মক সহায়তা করবে। নিজেদেরকে আমরা গড়ে তুলতে পারবো সঠিক পন্থায়। প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনই আমাদের প্রধান সাফল্য। তাই সকলকে আমরা সাধুবাদ জানাবো প্রযুক্তির সফরে যারা সচেতন করে তুলতে পারবে। তবেই আমাদের সকলের জন্য মঙ্গল কর হবে। সবাই আশাবাদী থাকি।

Leave a Comment