ভুল নাম্বারের বান্ধবীঃ প্রণয়যাত্রা ও বিবাহবন্ধনের ২য় পর্ব

এবার আশীর্বাদ এর দিনক্ষণ পাকাপোক্ত করার পালা চলে এলো। মেয়েপক্ষ বিয়েতে আর দেরি করতে চায় না। অনয়ের পরিবারেরও আপত্তি নেই। বরং তারাও চায়, এই ভরা সিজনেই যেন শুভ কাজটা হয়ে যায়। কেবল দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হলেই ঠিক হয়ে যাবে দিনক্ষণ।

বরাবরের মতো শিমুল ভাইকেই দায়িত্ব দেওয়া হলো সব কিছু ম্যানেজ করার জন্য। এই মানুষটি বরাবরই পরিবারের মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

আর অনয়? সে একা বসে, চোখে ফোনের পর্দা, মনে হাজারো প্রশ্ন। হ্যাঁ, বিয়ে ঠিক হয়েছে, মেয়ে দেখা হয়েছে। কিন্তু সম্পর্কটা তো এখনো একধরনের কাঁচা অবস্থায়। বিয়ের আগেই একটু আলাপ পরিচয় হলে হয়তো ভালো হতো।

সেদিন মেয়েটিকে খুব কম সময়ের জন্য দেখেছে সে। নাম রাইজা, ডাকনাম রাই। চোখে শাড়ির আঁচল, ঠোঁটে নরম হাসি, কিন্তু চোখে একরকম ভাবনা। ঠিক সহজে পড়া যায় না এমন মেয়ে।

শিমুল ভাই মেয়ের নাম্বার দিয়ে বলেছিলেন, “একটু কথা বলো, শুরু তো হলোই, এবার একটু জানা-শোনাও দরকার।” শিমুল ভাইয়ের মেয়ের সাথে সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছে। মেয়ের সাথে কথা বলে শিমুল ভাইয়ের ভালোই লেগেছিল। তিনি মেয়ের সাথে কম করে হলেও দুই থেকে তিন ঘন্টা কথা বলেছিলেন। ওনার সাথে সবচেয়ে বেশি কথা হয় আর সম্বন্ধ যেহেতু উনি এনেছেন তাই সকলের সাথে কথা বলার দায়িত্ব উনার উপরে বর্তায়। তিনি কথা বলার পর অনয়ের সকল বোনদের কে কথা বলার জন্য নাম্বার দিলেন শিমুল ভাই। অনয়ের সকল বোনদের সাথে কথা হল। এর মধ্যে ওর মেজ বোন খুবই এক্সপার্ট। তার সাথে কথা বললেই বোঝা যায় যে সে কেমন মানুষ হতে পারে মনে হয়। তার মেজ বোনের কথাই সবচেয়ে বেশি শুনে অনয়। ওর মেজ বোন ই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত গুলো দিতে পারে। তাই সে তার মেজ বোনকেই জিজ্ঞেস করল কিরকম লেগেছে ওর সাথে কথা বলে। ওর মেজ বোন ওর সাথে কথা বলে পজিটিভ রিভিউ দিল। অনেকটা আশ্বস্ত হলো সে বিষয়ে। তারপরে তার ছোট বোনের সাথেও কথা হলো। ছোট বোনের কিছুদিন আগেই বিয়ে হয়েছি।ল আর ছোট বোন একটু বেশি চঞ্চল। তার রায় নিয়ে সে আরো একটু বেশি নিশ্চিন্ত হল। পরিবারের প্রায় সকলেরই রায়ে চলে এসেছিল এবং সকলেই একটা পজিটিভ ভাইব তৈরি করেছিল। এবার তো তাহলে ওর কথা বলার পালা। কেননা অনয়ের তো বিয়ে ওর সাথে থাকতে হবে তারই। সকলের সিদ্ধান্ত তো সে এখন পেল। এখন তার নিজের কাছে কেমন লাগে সেটাই এখন দেখার বিষয়। তাই তার ছোট বোনের কাছ থেকে সে নাম্বার নিয়ে নিল। নাম্বার নিয়ে এখন একটা নক দিবে সে ভেবেছে। কারণ মেয়ের সাথে সেদিনও দেখতে গিয়ে তার কথা হয়নি। তাই শুরুতেই ফোন দিতে তার বিব্রত বোধ হচ্ছিল। সে সিদ্ধান্ত নিল সে হোয়াটসঅ্যাপই আগে নক দিবে। তারপর মেয়ের সাথে কথা বলে পরিচিত হয়ে পরে সে ফোনে কথা বলবে। সেই হিসেবে ছোট বোন থেকে সে নাম্বার নিল হোয়াটসঅ্যাপের এবং নাম্বার নিয়ে তাকে মেসেজ করার জন্য প্রস্তুত হলো।

অনয় সাহস করে হোয়াটসঅ্যাপে লিখে ফেললো:

“Hi, আমি অনয়। আমাদের দেখা হয়েছিল সেদিন। কেমন আছেন?”

প্রোফাইল পিকচার ছিল না, তবুও কিছুক্ষণ পর ‘online’ দেখা গেল। তারপর মেসেজ এলো:

“ভালো আছি। আপনি?”

চ্যাট শুরু হলো। প্রথমে অল্প অল্প, তারপর ধীরে ধীরে অনেক কথা। সিনেমা, বই, ছোটবেলার স্মৃতি, এমনকি ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও উঠে আসলো কথায় কথায়।

কিন্তু একটা বিষয় খচখচ করতে লাগলো—প্রোফাইল পিকচার নেই কেনো? মেয়েরা সাধারণত ছবি রাখতে পছন্দ করে। আবার কথাবার্তায় একটা অদ্ভুত খোলামেলা ভাব, যা রাইজার সঙ্গে প্রথম দেখায় মিললো না।

অনয় একদিন লিখলো:

“তুমি তো অনেক মজার, কিন্তু তোমার প্রোফাইল পিকটা কোথায়?”

সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই:

“কারণ আমি তোমার হবু বউ না। হা হা।”

অনয় ঘাবড়ে গেল।

“মানে? আপনি কে?”

“আমি আবির। ভাই, আপনি ভুল নাম্বারে প্রেম করছেন। আপনার হবু স্ত্রীর নাম্বারে এক ডিজিট ভুল ছিল। ওই নাম্বার আমার।”

অনয়ের মাথা ঘুরে গেল। রাগে-লজ্জায় গলা শুকিয়ে এল।

“তুমি আগে বলোনি কেন?”

“ভেবেছিলাম বলবো, কিন্তু আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগছিল। আস্তে আস্তে বন্ধু হয়ে গেলাম। আর আপনি তো মেয়েই ভেবে কথা বলছিলেন, আমি ভাবলাম একটু মজা নিই।”

অনয় কেবল লিখলো, “এই মজা অনেক বড় ঝুঁকিতে পরিণত হতে পারতো।”

পরদিন সাহস করে রাইজাকে ফোন করলো। সব খুলে বললো।

রাইজা একদম চুপ। তারপর শুধু বললো,

“তুমি নিজে বলেছো, এই ভালো লাগলো। তবে সত্যিটা না জানলে হয়তো আমি চিরদিন ভুল বুঝে থাকতাম।”

আশীর্বাদের তারিখ এগিয়ে এলো। দুই পরিবার মিলে স্থির করলো পরের শুক্রবার। শিমুল ভাই দায়িত্ব নিয়ে সব আয়োজন সামলাচ্ছেন। অনয়ের চেহারায় আনন্দের সাথে একরকম অস্বস্তিও আছে।

দিন দুয়েক পর, হঠাৎ সেই আবির আবার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করলো:

“ভাই, একবার কথা বলা যাবে?”

অনয়: “তুমি তো বলেছিলে, ভুল হয়েছে, এখন আর কী?”

আবির:

“ভুল তো ছিল, কিন্তু আপনার হবু বউ রাইজাকে আমি চিনি। ওর কিছু ছবি আছে আমার কাছে, একটু অন্য রকম ছবি। আপনি টাকা পাঠান, নইলে ওর বাবার কাছে পাঠিয়ে দেব।”

অনয় স্তব্ধ। মাথা যেন ফেটে যাবে। ব্ল্যাকমেইল!

“তুমি কী বলছো?!”

“আমি ফেক না, ওর কলেজ ফ্রেন্ড। ওর পার্টি করার ছবি, কিছু ভিডিও… বিশ্বাস না হলে স্ক্রিনশট দিচ্ছি।”

আবির আর রাইজা একই কলেজে ছিল। তো আবির একা আগে থেকেই চিনত রাইজাকে। যখন রাইজা সিম দোকান থেকে নিচ্ছিলো তখন আবিরও দোকানে উপস্থিত ছিল। সে তখন ডিজিট লক্ষ্য করছিল এবং রাইজালে কে চিহ্নিত করে রাখে। একই কলেজ এ থাকায় রাইজার উপর আগে থেকেই টার্গেট ছিল তার। এরকম মেয়েদের টার্গেট সে তার নেশায় পরিণত করে।সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে আগে থেকেই পড়াশোনা করেছে সে। তার ইচ্ছা ছিল যে সে ব্ল্যাকহ্যাট হ্যাকার হবে। দেশের বিভিন্ন মেয়েদের নাম্বার নিয়ে তাদের কে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য সে ছক কষত। সেই ফাঁদে যারাই পা দিত তাদেরকে সে ফাঁসিয়ে ফেলতো। এদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মেয়েকে সে ফাঁসিয়েছে প্রাইভেসি হ্যাক করে। তো যেহেতু তারা একই এলাকার ছিল এবং কাছাকাছি একটা নাম্বার একটা ডিজিট মাত্র পরিবর্তন করেছে সে। সিমটা নিয়েছে কিভাবে ব্ল্যাকমেইল করা যায় তাই ভাবছিল সে এবং সেই দিনটাতে হিট করে ফেলল কাকতালীয়ভাবে অনয়। কারণ অনয়কে যে নাম্বারটা দিয়েছিল তার ছোট বোন সেখানে যে ডিজিট টা ভুল ছিল কাকতালীয়ভাবেই আবিরের সাথে মিলে যায় এবং আবিরকেই মেসেজ দিয়ে ফেলে এবং যেদিনের অপেক্ষা করছিল সেই দিনটি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত তার হাতে এসে ধরা দিল আবিরের। তাই সে এই ব্যাপারটিকে আর হাতছাড়া করতে চাইলো না। আর সে তার মিথ্যে জালের ফাঁদে ফেলে দিল অনয়কে। যদিও অনয় খুব বুদ্ধিমত্তার সহিত বেরুতে পেরেছিল এবং সত্যতা তাকে দৃঢ়তা এনে দিয়েছিল।

অনয় রাতের ঘুম হারিয়ে ফেললো। বিয়ে তো এক সপ্তাহ পর! এখন কী করবে?

কিন্তু সে স্থির করলো—রাইজাকে কিছু না বলে নিজেই ব্যাপারটা সমাধান করবে। নিজের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাধ্যমে সাইবার ক্রাইম ইউনিটে রিপোর্ট করলো।

তিন দিনের মাথায় সত্যি ধরা পড়লো আসল চেহারা। আবিরের আসল নাম নাইম। সে একজন সাইবার প্রতারক। দেশের নানা জায়গায় মেয়েদের ছবি ব্যবহার করে ফেক প্রোফাইল খুলে ছেলেদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতো। পরে তাদের ব্ল্যাকমেইল করতো টাকা আদায়ের জন্য।

রাইজার কোনো দোষ নেই। সব মিথ্যে।

অনয় এবার সত্যিটা বললো রাইজাকে। পুরো ঘটনা খুলে বললো—কীভাবে সে ভুল নাম্বারে ফেঁসে গিয়েছিল, আবার কিভাবে সেই নাম্বারই এক ব্ল্যাকমেইলারে রূপ নেয়।

রাইজা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

“তুমি যদি না বলতে, হয়তো আমি বিশ্বাসই করতাম না। কিন্তু এখন আমি কৃতজ্ঞ যে তুমি আমাকে জানিয়েছো।”

১৫ দিন পর – ক্লাইম্যাক্স

আশীর্বাদ শেষ হয়েছে। বিয়ের দিনও নির্ধারিত। তবে অনয় ও রাইজা সিদ্ধান্ত নিয়েছে—তারা এ অভিজ্ঞতা শুধু নিজেদের মধ্যে রাখবে না।

ওরা এখন মিলে একটা প্ল্যান করছে।

“সাইবার সচেতনতা” নিয়ে ক্যাম্পেইন চালাবে—স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছোট ছোট সেমিনার, ওয়েবিনার, ইউটিউব ভিডিও বানিয়ে প্রচার করবে:

কিভাবে ভুল নাম্বারে বন্ধুত্ব বিপদ ডেকে আনতে পারে

হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে অচেনা কাউকে ব্যক্তিগত তথ্য না দেওয়া

ইন্টারনেটে ‘too friendly’ আচরণ কীভাবে ব্ল্যাকমেইলে পরিণত হয়

কিভাবে সাইবার অপরাধের শিকার হলে প্রতিবাদ ও রিপোর্ট করতে হয়

অনয়ের মা একদিন বললেন:

“তোমরা নিজেরা এমন কিছু শুরু করলে ভালো হবে। শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্যও কিছু করা দরকার।”

রাইজা হেসে বলেছিল,

“এই সমাজেই অনেক মেয়ে ভয় পেয়ে চুপ থাকে। আমি চাই ওরা যেন বুঝে—ভুল নাম্বারে শুধু ভালোবাসা না, বিপদও আসতে পারে।”

❝ ভুল নম্বরে ভালোবাসা নয়, হোক সচেতনতা। ইন্টারনেটের পর্দার ওপারে কে আছে, তা যাচাই না করে বিশ্বাস করাই সবচেয়ে বড় ভুল। ডিজিটাল যুগে এক ক্লিকে শুরু হয় সম্পর্ক, আবার ধ্বংসও। সচেতন হোন, নিরাপদ থাকুন। ❞

Leave a Comment