মামার হার্নিয়ার অপারেশন। হাসপাতাল নির্বাচনের পর্ব।

গত ২ বছর ধরে আমার মামা ওনার হার্নিয়া নিয়ে ভুগছেন। মূলত দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক ঝুট ঝামেলা চলছেই ওনার। কিছুতেই কোন কিছু করে উঠতে পারছেন না। আমারো অবশ্য একি হাল ই চলছে। কোন ইফেক্টিভ ইনকাম করতে পারছি না। যেখানেই হাত দিচ্ছি সেখানেই শুকিয়ে যাচ্ছে। মামাও চেষ্টা চালাচ্ছেন কিন্তু পারছেন না। এমতাবস্থায় ওনার হার্নিয়ার ব্যাথা টাও দিন দিন বাড়ছিল। চলাফেরা ত অসহনীয় হয়ে পড়ছিল ওনার জন্য৷ হার্নিয়া বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। তবে পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে কমন হলো ইনগুইনাল হার্নিয়া। যা পেটের ভিতরের যন্ত্র মূলত অন্ত্র পেটের পেশি কে চাপ দিয়ে নিচে কুচকির কাছে এসে ধাক্কা দেয়। এতে পেটের পেশীর প্রাচীর দূর্বল হয়ে পড়ে যা ঠিক অবস্থানে অন্ত্রকে ধরে রাখতে পারে না। এতে প্রচুর ব্যাথা হয়। আর খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে যেন পেট ছিড়ে বেরিয়ে আসবে অন্ত্রগুলো। এমতাবস্থায় দেরী করলে অনেক সময় রোগীর মুমূর্ষু অবস্থাও হতে পারে। এটাকে কুঁচকির অন্ত্রবৃদ্ধিও বলা হয়ে থাকে। এটি মূলত বয়স বাড়লে পেশি দূর্বল হলে হতে পারে, ভারী জিনিস কৌশল অবলম্বন না করে বেশি বেশি তুলতে থাকলে হতে পারে, এমনকি বার বার কাশির ফলেও পেটের পেশীতে চাপ পড়লে পেশী দূর্বল হয়ে এমনটা ঘটতে পারে। তবে নির্দিষ্ট কোন কারণ নেই হওয়ার। গবেষণার ফল থেকে এগুলোকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মামার ও ঠিক ইনগুইনাল হার্নিয়া ই ধরা পড়েছে। আর অনেক বেশি ভুগছিলেন। তেমন কোন সঠিক কর্মসংস্থান না হওয়ায় তিনি প্রস্তুতি ও নিতে পারছিলেন না অপারেশনের। এবার করতেই হবে মামাকে বললাম। আর দেরি করলে বিষয়টা আর‍ও জটিল আকার ধারণ করতে পারে। তাই মামাকে তড়িঘড়ি করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে বললাম। আর মামাও আমার কথা শুনে আশ্বস্ত হয়ে আমার সাপোর্ট চাইলেন। আমিও ফ্রী ছিলাম তখন। ওনাকে ডাক্তার দেখিয়ে সব রিপোর্ট রেডি করতে বললাম। উনি ওনার বাবার দেওয়া এক জায়গার পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করলেন। এবার টাকার বন্দোবস্ত ত হলো। অপারেশন এর জন্য প্রস্তুতি এবার শুরু করাই যায়।তাই আর দেরি না করে উনি ডাক্তারের কাছে গেলেন। সকল টেস্ট গুলো করিয়ে সব কিছু গুছিয়ে ফেললেন ২ দিন হাতে নিয়ে। এবার উনি সন্দিহান ছিলেন কোথায় করাবেন। সরকারি ও অপশন আছে। তবে দেশের সরকারি হাসপাতালে যে হাল। অপারেশন ঠিকঠাক হলেও পরবর্তী পর্যবেক্ষণ আর যত্নাভাব সরকারি হাসপাতালে প্রত্যাশা করা অকল্পনীয়। আর সরকারি তে ভাল সিট পাওয়ার সম্ভাবনা ও ত অমাবস্যার চাঁদ ই বলা চলে। আর অই জায়গায় রয়েছে দালাল চক্রের দৌরাত্ম। আর স্টাফদের চাঁদা বাজি করার কোন মাফ নেই। যে সকল আয়ারা থাকেন পরিচর্যার জন্য আর ওয়ার্ড বয় সকলেই প্রত্যেকদিনের একটা দাবী নিয়ে বসে থাকবে। তা না হলে ওনারা রোগীর পরিবারের সদস্যদের সাথে খারাপ আচরণ করবেন সাথে রোগীকে করবেন অবহেলা। সে হিসেবে খরচ একটু বেশি হলেও বেসরকারি প্রাইভেট হাসপাতালে করালে অন্তত একটু প্রশান্তি আর সেবাটা পাওয়া যাবে আশা করা যায় ঠিকঠাক। আর দেশে যেমন জনসংখ্যা তেমন রোগীর সংখ্যা উর্ধ্বমান। আর তাই চারপাশে শুধু প্রাইভেট মেডিকেল আর ক্লিনিকের রমরমা ব্যবসা। চলছে সব গুলো হাসপাতাল গুলো৷ কোথাও সেবা মিলছে ত আবার কোথাও মিলছে প্রতারণা। এমন ও কিছু ক্লিনিক পাওয়া গিয়েছে যেখানে সার্টিফিকেট বিহীন হাতুরে ডাক্তার বছর কে বছর ডাক্তার সেজে প্রতারণা করছে। আর এসব ডাক্তার অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে পেটের জায়গায় কেটে ফেলছেন পা। এ ত আরেক আতঙ্ক। তাই সঠিক ডাক্তার নির্বাচন করাও ত অত্যন্ত জরুরি।অনেক হাসপাতালে যোগাযোগ করার পর একজন ডাক্তারকে মামা নির্বাচন করলেন যিনি কিনা ওনাদেরই ব্যাচমেট। মামা জিলা স্কুলে ছিলেন না। তবে ওনার বন্ধু মহলের মধ্যে অনেকেই জিলা স্কুলে ছিলেন। তাদেরই পরিচিত কোরামের বন্ধু হচ্ছেন সেই ডাক্তার। তো মামা সেই পরিচিত কোরামে জানালেন যে ওনার এই এই সমস্যা বন্ধু হিসেবে যেন উনি একটু ফেভার করেন। মামার বন্ধুও তাই ফোন দিয়ে জানালেন তার ডাক্তার বন্ধুকে। বন্ধু বললেন আচ্ছা ঠিকাছে তাহলে সরকারিতে করিয়ে ফেলতে বলো। আর একবার চেক-আপের জন্য আসতে বলো। মামা বুঝলেন সরকারি ওনার অপারেশন ঠিকঠাক হলে পরবর্তী ট্রিটমেন্টে ভোগান্তি পোহাতে হতে পারে। মামা গেলেন বন্ধুর নিকট পরামর্শ নিতে কোথায় কিভাবে কি করা যায়। বন্ধু আশ্বস্ত করলেও এতটা সমীহ করেন নি। মামা বুঝলেন সবকিছু। তিনি অই শহরের প্রায় ৪-৫ টি হাসপাতালে অপারেশন করান রোগী বেসিসে। মামার এবার হাসপাতাল নির্বাচন করার পালা। কারণ ডাক্তারের অপারেশন খরচ ৮০০০ টাকা এটা ফিক্সড প্রত্যেকটা হাসপাতালেই। আর বাকি খরচ যে হাসপাতালে যেভাবে সেবা আর ডিসকাউন্ট প্রদান করতে পারে সে হিসেবে বিল কাটবে। মামা কয়েকজন ম্যানেজারের সাথে কথা বললেন। মোটামুটি এক হাসপাতালে ২৫০০০ টাকার প্যাকেজ। আর একটাতে বিশ হাজার। সর্বনিম্ন আঠারো হাজারের প্যাকেজ উনি নির্ধারণ করতে পারলেন যা অপারেশন সাথে হাসপাতালে থাকা আর অপারেশনের ওষুধ পত্র প্রদান করার কথা ছিল বোধ হয়। তবে হার্নিয়ার অপারেশনে আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে মেশিং। অর্থাৎ যে জায়গার পেশি দূর্বল হয়ে গেছে সে জায়গাটায় আবার অন্ত্রগুলো জায়গামতো গুছিয়ে এটাকে আবার সিল করে দিতে হবে যেন আবার অন্ত্রগুলোকে সঠিক স্থানে ধরে রাখতে সক্ষম হয়। সবচেয়ে ভালো মেশ নাকি প্রায় ২৫০০ টাকার মত পড়বে। সেটা ভারতীয় মেশ। সকল যাচাই বাছাই এর পর মামা শুক্রবারে আমাকে যেতে বললেন কারণ উনি একা একা ভরসা পাচ্ছেন না অপারেশন করতে যাওয়ার। আমি বললাম ঠিকাছে সে মোতাবেক প্রস্তুতি নিতে থাকুন। পরের দিন শুক্রবার আমি মামার বাসায় গেলাম। মামার তখন একটা টেস্ট করা বাকি ছিল। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে পড়লাম টেস্ট করার উদ্দেশ্যে। মামা তখনও দ্বিধান্বিত ছিলেন কোথায় অপারেশন করাবেন। অইদিন সকালেই উনি ওনার খুব কাছেই আরেকটি হাসপাতালের সন্ধান পান। আসলে এগুলো অনেক বিশাল শয্যার হাসপাতাল নয়। ক্লিনিক বলা চলে। মামার সেই ক্লিনিকের আরেকজন শেয়ার হোল্ডার আবার বন্ধু হন৷ মামা ওনাকে বললে উনি বললেন ঠিকাছে ওনারা সর্বনিম্ন টা ধরে রাখবেন। তো মামা যে এলাকার ক্লিনিকে গিয়েছেন সেই এলাকাতেই আমার কলেজ লাইফের বেস্ট ফ্রেন্ডের বাসা ছিল। আমি বন্ধুকে ফোন করে সব বিষয় জানালাম। বন্ধু বললো আরে উনি ত আমার বড় ভাই হোন। কোন সমস্যা নেই। আমি আসতেছি কিছুক্ষণের মধ্যে। তো মামার ইসিজি করাটা বাকি ছিল। কিন্তু অই ক্লিনিকে অইদিন ইসিজির টেকনিশিয়ান ছিলেন না৷ অগত্যা আমরা বেরিয়ে পড়লাম ইসিজি টা করিয়ে ফেলতে৷ ইসিজি করালাম আমরা বিশ্বস্ত একটা ল্যাবে। এর মধ্যেই বন্ধু শান্ত ফোন করে জানালো সেও চলে এসেছে। আর হাসপাতালের নিচেই অবস্থান করছে। মামার ইসিজি করানো শেষ হলে ওনাকে নিয়ে নিচে নামলাম। কলেজের দীর্ঘদিন পর বন্ধুর সাথে আবার দেখা করতে পারলাম। মামার রিপোর্ট দিতে তখনো আধাঘন্টা বাকি লাগবে। বন্ধু মামার কন্ডিশন সবকিছু ডায়াগনসিস করে নিল। কারণ বন্ধু অই শহরের ই একটি হাসপাতালের ফার্মেসীতে ইনচার্জ হিসেবে আছে। যার কারণে মেডিসিন ও মেডিকেল ফিল্ডে ওর একটা ভালো নেটওয়ার্ক তৈরি হয়ে গেছে। আসলে মেধাবীরা যেখানেই যায় সেখানেই অগ্রগতি আগুনের বেগে হয়ে যায়। বন্ধু মোটামুটি সব পরিচিত জায়গায় ওষুধপত্র আর ম্যাশের সম্পর্কে খোঁজ নিল। আর সর্বনিম্ন ৪০০ থেকে শুরু করে ২৫০০ টাকার ম্যাশের দাম যাচাই করল। তো ম্যাশের দাম সম্পর্কে তার ভালোই আইডিয়া বিদ্যমান৷ ওর ফার্মেসিতেই ম্যাশ রয়েছে। ও জানে এগুলোর কেনা দাম কত আর কত পার্সেন্ট লাভে ওরা তা রোগীরদের কাছে বিক্রি করতে পারে৷ আর এই অপারেশন হলে রোগী একদিন ই অঅবজারভেশনে থাকতে হয়৷ এর পরবর্তী দিনেই রিলিজ দিয়ে দেয়। তো বন্ধু যে হাসপাতালে কাজ করে সেই হাসপাতালেই অই শহরের স্বনামধন্য ল্যাপারোস্কপিক সার্জারী বিশেষজ্ঞ ও প্রফেসর অই হাসপাতালে বসেন। মামা যে বিশেষজ্ঞ বন্ধুর কাছে অপারেশন করাবেন বলে নির্ধারণ করেছিলেন ওনারো বাপ হোন তিনি। বন্ধুর কথায় সায় দিয়ে ফেললাম আর বললাম হাসপাতালের বিল কেমন আসতে পারে সেটা খোঁজ নিতে৷ বন্ধু আন্তরিকতার সহিত নির্দ্বিধায় খোঁজ নিয়ে সর্বনিম্ন রেট টা নির্ধারণ করল প্রায় ১১০০০ টাকার কাছাকাছি। সেটা আরো ২০০০+ হতে পারে বন্ধু আমাকে টাচ দিয়ে দিল৷ তো আর দেরি না করে তখন মাগরিবের সময় প্রায় ঘনিয়েছে বেরিয়ে পড়লাম বন্ধুর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। মামা বাইকে চড়তে ভয় পান৷ তাই ওনাকে রিক্সায় চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

Leave a Comment