
ট্রেনে উঠলাম। আন্টিকে সালাম দিলাম। আর ছোট ভাইয়ের সাথে কুশল বিনিময় হল। সিটে বসে বাইরের আবহাওয়া দেখতে লাগলাম। আমি জানালার পাশের সিট টায় বসলাম। ১০ মিনিটে আখাউড়া স্টেশনে পৌঁছালাম। রাজীব আমাকে একটার পর একটা প্ল্যান বলছে কি করা যেতে পারে। আখাউড়া স্টেশন থেকে বেরোতেই রাজীবের মাথায় একটা অভিনব প্ল্যান আসলো। সিলেট,সুনামগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল মোটামুটি হাওড় অঞ্চল ও বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ আছে। যেখানে হাঁস পালন অনেক জনপ্রিয়। আর সেখানে হাঁসের চাহিদাও অনেক। তো রাজীবদের যে জায়গা আছে সেখানে হাঁস পালন করা সবচেয়ে উপযোগী হবে বলে সে প্রস্তাব দেয়। আমাকে সে বিস্তারিত সব হিসাব দিতে লাগলো। হিসাবটা এরকম আমরা যদি ৫০০০ হাঁস পালনের টার্গেট নেই। তাহলে বছরে আমাদের টার্ন ওভার হতে পারে প্রায় ২০ লক্ষ টাকার মত। কিরকম ভাবে সম্ভব? ডিম। হাঁসের ডিমের চাহিদা অনেক। আর একেকটি ডিম খুচরা বাজারে ২০-২৫ টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে। আমরা পাইকারি বিক্রি করলেও কমে ১৬-১৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারব। তাহলে আমাদের এমন হাঁস ই নিতে হবে যেগুলো ২-৩ মাস পর থেকে ডিম দেওয়ার জন্য উপযোগী হয়ে যাবে। আর একেকটা থেকে আমরা ২ টি করে ডিম পেতে পারি।আর এই হিসাবে আমাদের যদি ডিম পাড়ার মত ২৫০০ হাঁস থাকে তবে ডিমের উৎপাদন কম করে হলেও ৪০০০ তো ধরাই যায়। আর যা আমাদের দিনে ৮০০০০ টাকার আমদানী হতে পারে। পরিকল্পনা আমার ভালই লেগেছে। তবে আড়াই হাজার সংখ্যাটা ত আর মুখের কথা নয়। জায়গা না দেখে আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তাই আমি সায় দিলেও নিশ্চয়তা তখন ও দিতে পারছিলাম না। পরিকল্পনাটা মাথায় রাখলাম। মন্দ ছিল না পরিকল্পনাটা। কেননা হাঁস পালন নিয়ে আমিও আগে একটু ঘাঁটাঘাটি করেছিলাম। দূরদর্শী চিন্তা ও বটে। অনেক উদ্যোক্তাই হাঁস পালন করে লাভবান হয়েছেন। বাইরে তাকিয়ে সুন্দর আবহাওয়া দেখতে লাগলাম। আকাশটা হঠাৎ করেই মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেল। তার একটু পরে বৃষ্টি নামলো।
বেশ ভালো লাগছিল পরিবেশটা। মূলত সিট ছিল আমাদের নেওয়া চারটা। কিন্তু আমরা লোক ছিলাম পাঁচজন। তাই ভাবতে লাগলাম হবে কিনা। একটু একটু আমাদের অস্বস্তিও লাগছিল। কারণ হচ্ছে ওর ছোট ভাই সহ তিনজন একসাথে বসে ছিল। তেমন বড় বিষয় ছিল না। কিন্তু বন্ধুর শান্ত একটু অস্বস্তি বোধ করবে বলে ভাবছিলাম। তেমন কিছুই হয়নি আর কি ফর্মালিটি। যদিও ট্রেনে তেমন ভিড় ছিল না ফাঁকাই ছিল। শায়েস্তাগঞ্জ যেতেই আমরা সিগারেট খেতে ট্রেনের দরজায় এগিয়ে দাঁড়ালাম। বন্ধু রাজিব খুবই উৎসাহিত ছিল। শায়েস্তাগঞ্জ থেকে আর বেশি দূর না শ্রীমঙ্গল। আধা ঘন্টা গেটে থেকে আবার আমরা বগিতে ফিরে আসলাম। তখন ট্রেন প্রায় ফাঁকা। কারণ শায়েস্তাগঞ্জ থেকে আধা ঘন্টা পাড়ি দিলেই শ্রীমঙ্গল। এই গল্প করতে করতেই আমরা তিনটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম শ্রীমঙ্গলে। ওখানে নেমেই আমরা শহরে পৌঁছে গেলাম। সেখান থেকে বন্ধু শান্ত একটি গেস্ট হাউস ঠিক করে নিল। এখানে জিনিসপত্র ব্যাগ পত্র রেখে আমরা খেতে চলে গেলাম রিযিক হোটেলে। রিজিকের স্থানে আগে পানশি ছিল। কিন্তু পানশি সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। নতুন একটি জায়গায় এখন নতুন করে পানশি হচ্ছে। রিজিকের পরিবেশটাও অনেক ভালো। আমি ছোট মাছ চাইলাম কিন্তু ছোট মাছের তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল আর কি করা আমাকে এসে বাইং মাছ ধরিয়ে দিল। খেয়ে দেয়ে আমরা দেরি করলাম না।বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে। সেদিন অবশ্য বেশি সময়ও ছিল না চলে গেলাম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। সেখানে টিকেটের দাম শুধু দিন দিন বেড়েই চলেছে। রাজিবের বাবা পুলিশ ছিলেন। তো সেই রেফারেন্সটা কাজে লাগিয়ে রাজিব টিকেট নিয়ে আসলো। উদ্যানে আসলে টিকিট রাখার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। একটা সময় তো টিকেট ছিল না পরবর্তীতে ২০ টাকা ধার্য করা হয়েছিল কিন্তু বর্তমানে তা বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে। কোন কোন সময় তো দেড়শ টাকাও রেখে থাকে। শহর থেকে বেরুতেই আবহাওয়া অনেক ঠান্ডা হয়ে গেল। পুরোই ভেজালমুক্ত অক্সিজেন। অনেক পোকামাকড় ডাকাডাকি করছিল। লাউয়াছড়া উদ্যানের ভেতর দিয়ে সিলেটগামী ট্রেনের ট্র্যাক গিয়েছে। সেখানে অনেক দর্শনার্থী এসে ছবি তোলা তুলি করে। আমরা হাটতে হাঁটতে আরো গভীরে চলে গেলাম। কিছু দূর যাওয়ার পরে আমরা বানর দেখতে পেলাম। বন্ধু শান্ত বলছিল কেন বানর দেখছি না কেন বানর দেখছি না। কিন্তু আর অপেক্ষা করতে হলো না। অনেক বানরের ঝাঁক দেখলাম এই গাছ থেকেও গাছ কাঁঠাল খাচ্ছে। আমি এর আগেও লাউয়াছড়া এসেছি। বন্ধু শান্ত ও এসেছিল। আর রাজীবের তো পূর্ব পরিচিত জায়গায়। এবার টার্গেট ছিল খাসিয়া পল্লী। মোটামুটি ৪৫ মিনিটের রাস্তা আমাদের হেঁটে যেতে হবে। আন্টি কিছুদূর যাওয়ার পরে একটু ক্লান্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু আমাদের সাথে থেকে তারুণ্যটা ওনার তখনও জীবিত ছিল। ছোট ভাই প্রথমবার শ্রীমঙ্গল এসেছে। সে অবশ্য আন্টির ভালই খেয়াল রাখছিল। পাহাড়ের গা বেয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম পল্লীতে। তাদের কি কঠিন জীবন। জীবন যুদ্ধে অবশ্য তারা এগিয়ে। শ্রম ছাড়া জায়গায় থেকে জীবনধারণ করা খুবই কঠিন। ওনাদের হাজার সদাই সবকিছুই দূর থেকে করে এসে পাহাড় বেয়ে বেয়ে উপরে নিয়ে পরিচালনা করতে হয়। কোন যানবাহন চলাচলের সুবিধা নেই। ওনারা অবশ্য অন্যান্য আদিবাসীদের থেকে অনেকটাই ভদ্র। কিন্তু ওনাদের এলাকাতে ওনারা বাঘ। তবে ওনাদের ধৈর্য শক্তি অনেক সেটা বোঝা যায়। উপরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিলাম। দুটোই দোকান রয়েছে। দাম বেশি জিনিসপত্রের সেটা স্বাভাবিক। আর দেরি করলাম না কারণ সন্ধ্যা নেমে আসছিল। উনাদের সম্পর্কে যেটা জানলাম আমাদের একজনই সরদার থাকে। উনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই তাদের সমাজ পরিচালিত হবে। কিউট কিউট অনেক ছেলে মেয়েদের দেখলাম। ভালোই নতুন সংস্কৃতি দেখতে আমার ভালই লাগে। ইচ্ছে করে ভাবি সেখানেই যদি আমি বড় হতাম তাহলে কেমন হতো। আবার ৪৫ মিনিটের পথ হেঁটে উদ্যানের গেটে পৌঁছে গেলাম। সেখান থেকে আর দেরি না করে চলে গেলাম মনিপুরী মার্কেটে। তখন আমি আর রাজিব কি করা যায় আর আন্টি আর ছোট ভাই গেলেন কেনাকাটা করতে। মনিপুরী মার্কেট অনেক আগে থেকেই বেশ নামকরা। উনারা নিজের হাতে সকল পোশাক তৈরি করে থাকেন। ওনাদেরই একটা আর্ট আছে আলাদা ঐতিহ্য আছে। যেটা যুগ যুগ ধরে ওনাদের পূর্বপুরুষ থেকে উনার শিখে এসেছেন। কালের পরিক্রমায় সেই শিল্প এখনও জীবিত রয়েছে। আর সেই অথেন্টিক মনিপুরী জিনিস কেনার জন্যই পর্যটকরা শ্রীমঙ্গল গিয়ে থাকেন। আন্টি দুটো ওড়না কিনলেন। তখন আকাশটা আবার মেঘলা হয়ে গিয়েছে। আকাশ ডাকছে বৃষ্টি নামবে বলে। তাই আমরা আর দেরি না করে শহরে ঢুকে পড়লাম। যেহেতু দুপুরে রিজিকে খেয়েছিলাম তাই রাতে খাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিলাম সাতকরায়। কারণ এর পূর্বেও আমি সাতকরায় খেয়েছিলাম ভালই ছিল। তাই আর দেরি না করে একটি অটো নিয়ে আমরা চলে গেলাম শহরে। সাতকরা গিয়ে বসে পড়লাম খাওয়ার জন্য। আন্টি আমাদের খাওয়া-দাওয়ার জন্য আপ্যায়নে কোন ত্রুটিই রাখতে দিচ্ছিলেন না। আর আমাদের খরচ করতে দেওয়া তো মোটেও না। আমি, শান্ত, রাজিব তিনজনেই রুটি অর্ডার করলাম। আন্টি আর ছোট ভাইয়ার জন্য ভাত। ভর্তা নিয়ে আসার পর আন্টি আমাকে একটু ভাত খাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিলেন। আমি আসলে সব সময় ভাতই খেয়ে থাকি উত্তরটা ফেলে দিতে পারলাম না। এক চামচ ভাতের সাথে ট্রাই করলাম ভালই লাগলো। ভাত খেতে খেতেই আমাদের রুটি চলে আসলো। প্রথমে ছয়টা অর্ডার দিয়েছিল সেগুলো খেলাম। কিন্তু বন্ধু শান্ত আরো ছয়টা অর্ডার দিয়ে দিল। এগুলোতো আর পরোটা নয় ছিল তন্দুল। আর তন্দুর এত ভারী আর বড় হয়ে থাকে যেটা আসলে দুটো খেলেই পেট ভরে যায়। কষ্ট করে আমরা সবাই মিলে খেলাম। আমি তো আর পারছিলামই না কিন্তু আমার আগেই রাজিব হাল ছেড়ে দিয়েছিল। শুধু রাজিব নয় শান্ত পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছে। অগত্যা তো ভাইকে দিয়ে একটা খাওয়ালাম। আরো একটা বেগুন ভর্তা আনিয়ে কোনরকম খেলাম। বেশি ওভারলোড হয়ে গিয়েছিল। ভালই লাগলো এখান থেকে আমরা বেরিয়ে পড়লাম তখন বাজে প্রায় রাত দশটার কাছাকাছি। রাতের জন্য খাবার সেগুলো কিনে পৌঁছে দিলাম রেস্ট হাউস পর্যন্ত। পরের দিন আমাদের অনেকগুলো টাইমিং। বন্ধু শান্তর রিজিকে সকাল বেলার আখনি খাওয়ার খুব ইচ্ছে। সে আগের বারও এসেছিল কিন্তু খেতে পারেনি দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে। এবার আর সে মিস করতে চায় না। তাই ফজরের পর পরই বেরিয়ে যাওয়ার প্ল্যান। ওই রাতের মতো সকলকে বিদায় দিয়ে আমি আর রাজীব পায়চারি করতে করতে চলে গেলাম রেলওয়ে স্টেশনে। সেখানে বন্ধুকে জায়গাটা কীভাবে উপস্থাপন করা যায়। কী প্ল্যান নিয়ে আমরা এগুতে পারি। সে ব্যাপারেই আলাপ আলোচনা করছিলাম আর সিগারেট সাটাচ্ছিলাম। অনেক ঘুরাঘুরি ত হলো এবার একটু বিশ্রাম নেওয়া ও দরকার। আকাশের অবস্থাও ভালো ঠেকছিলনা।