
কসবা পর্ব
ভ্রমণ। এক কথায় পুরো বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে আমরা সবাই ভ্রমণ ই করছি। আর যতদিন রথ ততদিন পথ। এই বাক্যে আমিও বিশ্বাসী। তাই কোথাও ভ্রমণের প্রস্তাব আসলে সরাসরি তা গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করি না। সেক্ষেত্রে টাকা থাকুক আর না থাকুক। ভাই-ব্রাদার তো আছেই। তো একেবারে তাজা ভ্রমণ আমার শ্রীমঙ্গল। এই ত ২০২৫ এর মে মাসে। টাকার টানাপোড়েন ও আগের মতই। এবার তো একেবারেই কম। মাত্র এক হাজার টাকা বাজেট। এটা আমার শ্রীমঙ্গলের তৃতীয়বারের যাত্রা। আর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও বটে।প্রথম দুই যাত্রার গল্প ও বলবো। কিন্তু এইবারের যাত্রাই আমার জীবনে শ্রীমঙ্গলের উল্লেখযোগ্য তাৎপর্য সৃষ্টি করেছে। সূত্রপাত অই মামার অপারেশনের কাহিনি থেকে। আমার কলেজের প্রিয় বন্ধু শান্তর শ্রীমঙ্গল যাত্রার অভিজ্ঞতা।বিশেষত শ্রীমঙ্গলের আবহাওয়া,ঐতিহ্য,নির্জনতা। আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বলার তো আর কোন অপেক্ষাই রাখে না। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সাজানো গুছানো চাবাগানে বুনিত পরিপাটি পরিবেশ। শহরের যান্ত্রিকতা থেকে যেখানে হারিয়ে যাওয়া যায় প্রকৃতির বন্ধনে। আর বন্ধু শান্ত ও তাই কুমিল্লা জেলা শহরের কেওয়াজে থাকতে থাকতে একটু শান্তির খোঁজে শ্রীমঙ্গলে জায়গা কেনার ইচ্ছা পোষণ করে। যেহেতু আমার দুই জেঠাতো ভাই থাকেন। আমিও প্রস্তাব দেই যে হ্যাঁ জায়গা পাওয়া সম্ভব। ওর আগে থেকেই ধারণা ছিল শহরের বাইরে পাহাড়গুচ্ছে জায়গার দাম অনেকটাই সহজলভ্য। কিন্তু আমার মনে পড়ে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু রাজীবের কথা যে কিনা বলেছিল ওদের শ্রীমঙ্গল আগে থেকেই জায়গা কিনা রয়েছে। সেই জায়গায় দীর্ঘদিন যাবত ওদের যাওয়া হচ্ছে না আর সেই জায়গাটা ছেড়ে দেওয়ার ও চিন্তাভাবনা করছেন ওনারা। তাই বন্ধু শান্তকে প্রস্তাব দিলাম কোন চিন্তাই নেই জায়গা সহজেই পেয়ে যাবে। বন্ধু আশ্বস্ত হয়ে বললো – “ঠিকাছে, তাহলে প্ল্যান কর শ্রীমঙ্গল যাওয়ার।” সেই কথা মতোই এলাকায় এসে রাজীবকে সব খুলে বললাম।

রাজীব ত খুবই উৎসাহিত হলো অই বিষয়ে। রাজীবের অনেক স্মৃতি শ্রীমঙ্গলের। এক দুই বছর নয় প্রায় এক যুগের ও উপরে অভিজ্ঞতা। তার শৈশব-কৈশোর পুরোটাই কেটেছে অইখানে। বিস্তারিত সব গল্প ই এক এক করে বললো আমাকে সে। রাজীবের ফুফাতো ভাইয়েরা অইখানের আছে দীর্ঘবছর ধরে। ওর ফুফা দেশ স্বাধীনের আগেই পাড়ি জমান শ্রীমঙ্গলে। সেখানে লন্ডনপ্রবাসী পাহাড় মালিক একশত বছরের জন্য জায়গার লিজ দেন ওনাদের দেখাশোনা করার জন্য। অনেক বছর পেড়িয়েছে তবে উল্লেখযোগ্যভাবে তেমন কিছু করা হয়নি পাহাড়গুলোতে। বন্ধু রাজীবের মাথায় আসলো ব্যবসায়িক কোন কাজ করা যেতে পারে। কেননা শ্রীমঙ্গল হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরতম পর্যটনস্থান। এটি উপজেলা হওয়া সত্ত্বেও সুযোগসুবিধা জেলাশহরকেও হার মানায়। কি নেই ওখানে। উল্লেখযোগ্য পর্যটন খাত হওয়ায় আর বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনায় এই উপজেলাই বাংলাদেশের রাজস্ব খাতে বড় একটি ভূমিকা রাখছে। যদিও এটি বাংলাদেশ তাই দূর্নীতি ও চোখে পড়েছে বিভিন্নখাতে। এগুলো একটি পরে আলাপ করছি। তো আমাদের প্রথম প্ল্যান হয় অই পাহাড়গুলোতে রিসোর্ট স্থাপনের। তবে তা সহজ কাজ নয়। এর জন্য দরকার একটি বড় অঙ্কের ইনভেস্টমেন্ট। আর বন্ধু শান্ত তো চাচ্ছে জায়গা কিনতে তাও তার বাজেট লাখ দুই-এক। আমিও আশাবাদী ব্যবসার জন্য ভাল পর্যটন খাত হচ্ছে এই শ্রীমঙ্গল। করতে পারলে ব্যবসা হবেই রাজীব ও বরাবরের মতো অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী। আর ওর কথাও আমি ফেলে দিতে পারি না। আমার মতে সম্ভাবনা যেখানে সৃষ্টি হবে সেখানেই চেষ্টা চালাতে হবে। এখন বন্ধুদের সাথে ত পরিচয় করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। তাই একটি হোয়াটস এপ গ্রুপ খুললাম। শ্রীমঙ্গল ১.০ নামে। গ্রুপে বন্ধুদের সাথে আলাপ হলো। রাজীব শ্রীমঙ্গলের ব্যবসার সম্ভাবনা নিয়ে সবকিছু খুলে বলল শান্তকে। শান্ত ও খুব উৎসাহিত ছিল। তবে বন্ধু এতটা আত্মবিশ্বাসী ছিল না। আর অতটা ইনভেস্ট করার ক্ষেত্রেও সে একটু অপ্রস্তুত ছিল। যাই হোক আমাদের যাত্রার সময় ঠিক করা হলো। ২৩ শে মে সাথে শান্ত এর আম্মু আব্বু ও যাবে। আর আমরা বললাম কসবা রেলস্টেশনে থাকব। এর মধ্যে রাজীবের সাথে আমার আরো আলাপ হলো কি করা যেতে পারে। সে আমাকে আরো কিছু সাজেশন দিন রেস্টুরেন্টের বিজনেস ও করা যেতে পারে। তবে যে ইনভেস্টমেন্ট দরকার তার ফান্ড ছিল অপ্রতুল। আর আমরা দুইজনই এই মুহূর্তে পথের ফকির ই বলা চলে। তবুও আশাবাদী যদি ভালো কিছু হয়। তো কাঙ্খিত দিন চলেই আসলো। ২২শে মে বিকালেই রাজীব আমাকে ফোন দিল বিকাল বেলা। তার যেন তর সইছে না। সে তখনই প্রস্তাব দিচ্ছিলো রওনা দেওয়ার। অইদিন আকাশ ছিল গোমট। মেঘাচ্ছন্ন ছিল সারাদিন। বৃষ্টিও বোধ হয় হয়েছিল কিছুক্ষণ। তবে যাই হোক গরম কিন্তু তখন ও কমেনি। কিন্তু তখনই নিউজে জানতে পারি ২০০৯ সালের পর এবার মৌসুমি বায়ু সময়ের আগে চলে এসেছে। বৃষ্টির ভাবটাও দমাদম। ভালই লাগে বেশ। আমার খুবই বৃষ্টি পছন্দের। ঠিক হলো সকাল সকাল উঠতে হবে। বের হতে হবে ৯ টা নাগাদ। রাজীব আমাকে ঘুম থেকে তোলার দায়িত্ব নিল। রাতে দেরি করে ঘুমিয়েছিলাম। প্রায় ৩ টার কাছাকাছি সময়। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। পায়চারি করছিলাম খাটের এপাশ ওপাশ। এভাবে আমি ৩ টার পরে ঘুমালে উঠি সকাল ১১ টা কি ১২ টা। কিন্তু যখন সকালে আমার কোন কাজ থাকবে সেদিন কখনোই ঘুম আসতে চাইবে না আর আসলেও একটু পর পর ঘুম ভেঙে যায়। কিসের যেন তাড়া এলার্ট করে রাখে আমাকে সবসময়। অইদিন ও তাই হলো ৪ বার ঘুম ভাঙলো আমার। উঠছি আর ফোনে সময় দেখছি। আর সকালের ঘুম টা কিন্তু সবসময় ই প্রগাঢ় হয়। শেষ ৭ টার কাছাকাছি সময়ে ঘুম ভেঙে ছিল। কথা ছিল ৮ টার দিকে ঘুম থেকে উঠার। সকাল ৭:৩০ বাজতে না বাজতেই ফোনের ভাইব্রেটে আমার ঘুম ভেঙে গেল। রাজীবের ফোন। ফোন ধরতেই “বন্ধু, উঠো,উঠো। এখনি বের হতে হবে ১১ টায় ট্রেন। আর আমাদের ট্রেন ধরতে হবে কসবা থেকে।” উঠে পড়লাম। রেডি হয়ে দুই মুঠো শুকনো খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাথে ছিল একটি ছোট বাঞ্জি ব্যাগ। সেখানে চার্জার আর কিছু প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মন্ত্রী বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানেই রাজীবের সাথে একসাথে হয়ে কসবা যাওয়ার পরিকল্পনা হয়। সেই মোতাবের আমি প্রায় ৮:৪৫ নাগাদ বেরিয়ে উত্তর পাড় হয়ে মেইনরোডে গিয়ে সিএনজি তে উঠি। রাজীব ও তখন বেরিয়ে পড়েছিল। মেইনরোডে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই সিএনজি পেয়ে ফেলি। আর ৯:৩০ নাগাদ পৌঁছে যাই গন্তব্য। গিয়ে দেখি বন্ধু ও ঠিক টাইমে পৌঁছে গেছে। এবার একটু চা খেয়ে ২০ মিনিট পর আমরা বেড়িয়ে পড়লাম কসবার উদ্দেশ্যে। শান্তর ট্রেন ছাড়ার কথা কুমিল্লা থেকে ১০ টায়। আর কুমিল্লা থেকে কসবার ট্রেন দূরত্ব মাত্র ১ ঘন্টার। কসবার উদ্দেশ্যে যেতে যেতেই শান্তকে ফোন করলাম।
শান্ত তখন কুমিল্লা রেলস্টেশনে ছিল। আংকেল আসে নি সাথে আসছে আন্টি আর ওর এক ছোট খালাতো ভাই। অইদিনই ট্রেনের সময়ের বিপর্যয় ঘটলো ১০ টার ট্রেন কুমিল্লাই এসে পৌঁছাবে ১১:৩০ টা নাগাদ। অফুরন্ত সময় এখন আমাদের হাতে। আমরাও পৌঁছে গেলাম ১০:২০ নাগাদ কসবা। সময় ত কাটাতে হবে। হাতে তখন আড়াই থেকে তিন ঘন্টা বাকি। কসবা কিন্তু একেবারেই ভারতের বর্ডার ঘেষা একটি এলাকা। এখানে অনেক লোকের আনাগোনা থাকে আশেপাশের অঞ্চল গুলো থেকে। কারণ এই এলাকায় অনেক খাজানাই আছে তাদের জন্য। ভারতীয় পণ্য ও ওষুধের টানে এখানে অনেক লোকের ই আগমন ঘটে। কসবা রেলস্টেশনের পাশেই ভারতীয় একটি বাজার আছে। ঐ বাজারে ফেন্সিডিল খেতে মূলত অনেক গ্রাহক আসে অই এলাকায় তাই অই জায়গাটা একটা স্পট। আমরা কসবা নেমেই নাস্তা করতে চলে গেলাম একটি হোটেলে। সেখানে গরম গরম সিঙারা আর হালুয়া দিয়ে রুটির রোল খেয়ে পেট পুড়লাম। তারপর সিগারেট সাটাতে সাটাতে ঢুকে গেলাম রেলস্টেশনে। তখনও ট্রেন আসতে প্রায় ২ ঘন্টা বাকি। কি আর করার ভিতরে ঢুকে রেলস্টেশনে ঘুরাঘুরি করতে লাগলাম। প্রচন্ড রোদ ছিল। একটা পানির বোতল কিনে চলে গেলাম ওভারব্রীজের উপরে। অসাধারণ ভিউ দেখা যাচ্ছিল সেখান থেকে চারপাশে।

তীব্র রোদে ঝলসে যাচ্ছিল পুরো এলাকা। কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে বসে পড়লাম এক কোণায়। তখনই আমার ক্যাম্পাসের রুমমেট গৌরবের ফোন এল দীর্ঘদিন পর। বন্ধু স্মরণ করেছে দেখে ভালই লাগলো। কথা শুরু হলো সমসাময়িক টপিকে। এর মধ্যে শান্তরও রাজীবের সাথে কথা হলো। ট্রেন ও চলে এসেছিল কুমিল্লায়। আর মাত্র ১ ঘন্টা অপেক্ষা। গৌরবের সাথে কথা যেন থামছেই না। ওর প্রফেশনাল ফিল্ড, উচ্চশিক্ষা নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। এখানে গরমে ফাটাফাটি। বুঝতে পারছিলাম রাজীব বিরক্ত হচ্ছিল। কিন্তু কি করা গৌরবের সাথেও এ বছরে প্রথম কথা হচ্ছিল। ৪৫ মিনিটের মত আলাপের পর থামলে আমার ফোন। রাজীবের ক্লান্ত ঘামার্ত মুখে উঠে দাঁড়ালাম। রেলিং এ হাত দিয়ে একটু দাঁড়াতেই রাজীবের হাত থেকে পানির বোতল টা ফসকে গেল। ধপাস করে একটা আওয়াজ দিয়ে বোতলের ঢাকনাটা ফেটে গেলো। ভাগ্য ভালো তখন নিচে কেউ ছিল না। কি আর করা ধীরে ধীরে আমরা নিচে নেমে গেলাম। নেমে তখন আরেকটা পানির বোতল আর সিগারেট কিনে সময় কাটাতে লাগলাম। রাজীব বললো একটু জুতা টা কালি করা জরুরি। স্টেশনে ঢুকতেই একজন মুচির দোকান ছিল। অইখানে সকল ভাসমান বিক্রেতারা একসাথে ফোনে ক্যারাম খেলছিল। রাজীব ভাবছিল ওদের কি ডিস্টার্ব করবো? কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রাজীব বললো, “ভাই জুতাটা কালি করা যাবে?” মুচি খেলা বন্ধ করে বললো, “অবশ্যই। তিরিশ টাকা লাগবে।” সময় ও তখন কম আর করাটাও প্রয়োজন। কাজটা হতে হতেই শান্তর ফোন ট্রেন ঢুকবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। জুতা কালি করার পরপরেই প্লাটফর্ম এ দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট জ্বালাতেই ট্রেনের সিগন্যাল দেখা গেল দূরে লাল বাতিতে। একেবারে খাপে খাপ সময়ে আমরা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে। বন্ধু শান্ত আগে থেকেই একটি সিট বেশি কেটেছিল। ২ মিনিটের ভিতরে ট্রেন এসে দাঁড়ালো প্লাটফর্মে। শান্ত আমাদের আগে থেকেই বলেছিল ‘ট’ বগি ৪৪-৪৫ নাম্বার সিট। আমরা ভেবেছিলাম ট বগি পিছনের দিকে থাকবে কিন্তু ট্রেন উলটা এসেছিল যার কারণে ট বগি ছিল সামনের দিকে। সামনে আগাতেই বন্ধু শান্ত মাথা বের করে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল আমাদের জন্য। জানালা দিয়ে মাথা বের করে ঠিক তাক করে আমাদের খুঁজে বের করলো। আমরা ট্রেনে উঠে গেলাম। আর ৫ মিনিটের মধ্যেই কসবা আবার থেকে ট্রেন যাত্রা শুরু করল।
খেলাটা সেরা হইছে